Image

টেম্বা বাভুমা: লর্ডস জয়ের চেয়েও বড় এক বিজয়ের নাম

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ: 5 ঘন্টা আগেআপডেট: 1 সেকেন্ড আগে
টেম্বা বাভুমা: লর্ডস জয়ের চেয়েও বড় এক বিজয়ের নাম

টেম্বা বাভুমা: লর্ডস জয়ের চেয়েও বড় এক বিজয়ের নাম

টেম্বা বাভুমা: লর্ডস জয়ের চেয়েও বড় এক বিজয়ের নাম

২৭ বছরের অপেক্ষার শেষে, দক্ষিণ আফ্রিকার আত্মপরিচয়ের এক নতুন প্রতীক
টেম্বা বাভুমা। হয়তো ক্রিকেট দুনিয়ার গ্ল্যামারাস কোনো পোস্টারবয় নন, কিংবা বিজ্ঞাপনের আলোয় মোড়া কোনও সুপারস্টার নন। কিন্তু ইতিহাস তাঁকে ভুলবে না। কারণ তিনি জয় করেছেন শুধু একটা ম্যাচ নয়—জয় করেছেন সময়, বর্ণবাদের ছায়া, আর একসময়ের অবিশ্বাসকে।

লর্ডস টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে যখন দক্ষিণ আফ্রিকা ২৭ বছর পর একটি বড় শিরোপা ঘরে তোলে, তখন দলের সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন একজন এমন অধিনায়ক, যাকে অনেকেই প্রথমদিনেই ছেঁটে ফেলার মতো ভাবতেন। "কোটা প্লেয়ার"—এই অপবাদ নিয়েই শুরু হয়েছিল বাভুমার যাত্রা। কিন্তু শেষটা হলো ‘চ্যাম্পিয়ন অধিনায়ক’ পরিচয়ে।

একজন ‘কোটা প্লেয়ার’ কীভাবে হয়ে উঠলেন জাতির আত্মপ্রতিকৃতি

দক্ষিণ আফ্রিকার মতো একটি দেশে, যেখানে ইতিহাস জুড়ে জাতিগত বৈষম্যের দাগ রয়ে গেছে, সেখানে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রিকেটারের জন্য শুধু দক্ষ হওয়াই যথেষ্ট নয়। তাঁকে প্রমাণ করতে হয়—তিনি তোষণের ফসল নন, প্রতিভার প্রতিফলন।

বাভুমা ছোটবেলা থেকেই এই বোঝা নিয়ে বেড়ে উঠেছেন। যাঁরা তাঁর উচ্চতা নিয়ে হাসাহাসি করেছেন, তাঁরা হয়তো বুঝতে পারেননি—এই মানুষটির কাঁধেই চাপানো ছিল গোটা একটি ইতিহাসের ভার।

২৭ বছরের অপেক্ষার অবসান, এক ব্যথাতুর জয়

২০২৫ সালের লর্ডস টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনাল দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য ছিল শুধুমাত্র একটি ম্যাচ নয়—এটি ছিল ‘চোকার্স’ অপবাদ ঘোচানোর সুযোগ।
প্রথম ইনিংসে দলের ব্যাটিং বিপর্যয়ের মাঝে বাভুমার ৪৬ রানের ইনিংস ছিল ধৈর্য আর সাহসের এক প্রতিচ্ছবি। দ্বিতীয় ইনিংসে হ্যামস্ট্রিংয়ের চোট নিয়ে ব্যাট হাতে নামা, ম্যাচ জেতানো জুটি গড়া এবং ৬৬ রানের বীরোচিত ইনিংস—এই সবই মিলিয়ে তাঁর নেতৃত্ব এক ঐতিহাসিক অধ্যায়ে রূপ নেয়।

এই জয় কেবল একটি শিরোপা নয়, এটি ছিল আত্মসম্মানের পুনরুদ্ধার। দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট, যা এতদিন জাতিগত বৈষম্য আর বিভাজনের প্রতীক ছিল, এবার সেই একই ক্রিকেট মাঠে নতুন এক গল্প লিখল—বাভুমার নেতৃত্বে।

লর্ডসে ইতিহাস, আর হ্যামস্ট্রিংয়ের ব্যথায় বীরত্ব

২৭ বছর ধরে দক্ষিণ আফ্রিকা কোনও বড় শিরোপা জেতেনি। সেই খরা ঘোচাতে লর্ডসের মাঠে চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার। প্রথম ইনিংসে দলের বিপর্যয়ে বাভুমা করেন লড়াকু ৪৬ রান। দ্বিতীয় ইনিংসে ২৮২ রানের লক্ষ্য তাড়ায় এইডেন মার্করামের (১৩৬) সঙ্গে গড়েন ১৪৭ রানের ম্যাচজয়ী জুটি।

বাভুমা তখন ব্যাট করছিলেন হ্যামস্ট্রিংয়ে চোট নিয়ে। চোট পেয়েছিলেন মাত্র ছয় রানে পৌঁছেই, কিন্তু তবু থামেননি। সিঙ্গেলস নিয়েছেন বুঝেশুনে, ডাবলসের সময় ব্যথা সহ্য করে খেলেছেন। ৬৬ রানের সেই ইনিংস শুধু দলের ভিত গড়ে দেয়নি, অনুপ্রাণিত করেছে গোটা দলকে।

শেষে মালডার (৪*) ও বেডিংহ্যাম (২১*) দলকে পৌঁছে দেন গন্তব্যে। দক্ষিণ আফ্রিকা ৫ উইকেটে হারায় অস্ট্রেলিয়াকে, আর বাভুমা হয়ে ওঠেন ইতিহাসের নতুন নায়ক।

প্রডিজি, তবুও সন্দেহের ছায়া

২০১৬ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ হিসেবে টেস্ট শতরান করেন বাভুমা। কিন্তু দ্বিতীয় সেঞ্চুরি আসতে সময় লেগে যায়। তাঁর ব্যাটিং গড় নিয়ে বারবার প্রশ্ন উঠেছে—এই গড় (৩৮) দিয়ে কী তিনি ‘বিশেষ’?

তাঁর উত্তর ব্যাটে নয়, ইতিহাসে।

বাভুমা এমন এক খেলোয়াড়, যিনি ছেনি-হাতুরি হাতে খোদাই করেছেন নিজের পরিচয়। তিনি ছিলেন না মিডিয়া ফেভারিট, ব্র্যান্ডের পোস্টার বয় কিংবা হেডলাইনের ‘মার্কেটেবল’ চরিত্র। তাঁর ছিল কেবল অধ্যবসায়, চরিত্র আর নেতৃত্বের সাহস।

গত তিন বছরে তাঁর গড় প্রায় ৬০। অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে হোবার্টে ৯৫, নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৮৯, ঘরের মাঠে সাহসী ইনিংস—সব মিলিয়ে নিজেকে প্রমাণ করেছেন মাঠে, নিজের মতো করেই।

নেতৃত্ব যেখানে প্রতিক্রিয়া নয়, প্রজ্ঞার প্রতিফলন

বাভুমা যখন অধিনায়ক হলেন, তখন অনেকেই বলেছিলেন—এটা কোটা-নির্ভর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু পরিসংখ্যান অন্য কথা বলছে—দশ ম্যাচে আট জয়, একটি ড্র, এবং টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে শিরোপা জয়।
ফ্যাফ ডু প্লেসি কিংবা ডি ভিলিয়ার্সদের চলে যাওয়ার পর যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, সেটিকে ভরাট করেছেন বাভুমা নিজের উপস্থিতি দিয়ে, মুখ দেখিয়ে নয়।

সংখ্যার বাইরেও এক বিজয়

বাভুমার পরিসংখ্যান হয়তো তাঁকে ক্রিকেট ইতিহাসের এক নম্বর ব্যাটার বানাবে না। কিন্তু প্রতিটি ইনিংস, প্রতিটি লড়াই—সবকিছুই তাঁকে পরিণত করেছে প্রতীকীতে।
যেখানে পরিসংখ্যান থেমে যায়, সেখান থেকে শুরু হয় বাভুমার মূল্য।

তিনি ছিলেন এমন একজন নেতা, যিনি দলের ভেতর সাহস ছড়িয়ে দিয়েছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন সামনে থেকে, এবং প্রমাণ করেছেন—আত্মসম্মান ও অটল মনোবল দিয়েই ইতিহাস বদলানো যায়।

বর্ণবাদকে পাশ কাটিয়ে, এগিয়ে চলা এক ক্রীড়াসংস্কৃতি

দক্ষিণ আফ্রিকার ক্রিকেট দীর্ঘ সময় ধরে অভ্যন্তরীণ বৈষম্যের অভিযোগে পর্যুদস্ত ছিল। কোটা পদ্ধতির সমালোচনার মাঝেও বাভুমার উঠে আসা একটি বার্তা দেয়—বিভাজন নয়, প্রতিভাই চূড়ান্ত মাপকাঠি হওয়া উচিত।
আর এই প্রতিভা তখনই পূর্ণতা পায়, যখন নেতৃত্বের দায়িত্বও দক্ষ হাতে তুলে দেওয়া হয়—বর্ণ নয়, যোগ্যতার ভিত্তিতে।

ক্রিকেটের বাইরেও এক সমাজনির্মাতা

২০১৬ সালে গড়ে তোলা ‘Temba Bavuma Foundation’-এর মাধ্যমে তিনি সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। ক্রিকেট প্রশিক্ষণ, স্কুল বৃত্তি ও অবকাঠামোগত সহায়তার মাধ্যমে তিনি নিজের শেকড়ের দিকেই ফিরছেন বারবার। এই কাজগুলো তাঁর ক্রিকেটের বাইরের, কিন্তু সামগ্রিক পরিচয়ের ভিত।

শেষ কথা..

টেম্বা বাভুমা হয়তো মাঠে সবচেয়ে বেশি রান করেননি, কিংবা সবচেয়ে বেশি স্টাইলিশও নন। কিন্তু তিনি এমন একজন ক্রিকেটার, যিনি দক্ষিণ আফ্রিকার জন্য শুধু একটা ম্যাচ জেতাননি—জিতিয়েছেন এক আত্মবিশ্বাস, একটি জাতির বিবেক। লর্ডসে শিরোপা জয়ের দিন শুধু ব্যাট নয়, ইতিহাসও ছিল তাঁর হাতে।
তিনি প্রমাণ করেছেন—প্রতীকও জিততে পারে, যদি তাতে থাকে সত্যিকারের নেতৃত্ব আর অবিচল সাহস।

Details Bottom
Details ad One
Details Two
Details Three