Image

ওয়ার্ন-মুরালির যুগে বাংলাদেশের ছিলেন একজন রফিক

৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল

প্রকাশ: 2 ঘন্টা আগেআপডেট: 1 সেকেন্ড আগে
ওয়ার্ন-মুরালির যুগে বাংলাদেশের ছিলেন একজন রফিক

ওয়ার্ন-মুরালির যুগে বাংলাদেশের ছিলেন একজন রফিক

ওয়ার্ন-মুরালির যুগে বাংলাদেশের ছিলেন একজন রফিক

ক্রিকেটের ইতিহাসে যাঁরা স্পিনে বিশ্বকে মোহিত করেছেন, তাঁদের নাম নিলে উঠে আসেন শেন ওয়ার্ন, মুত্তিয়া মুরালিধরনের মতো কিংবদন্তিরা। তবে তাঁদের ছায়াতলে দাঁড়িয়ে, এক ভিন্ন প্রেক্ষাপটে, নিরলস লড়াই করে যিনি গড়েছিলেন বাংলাদেশের প্রথম ক্রিকেট স্বপ্নের ভিত তিনি মোহাম্মদ রফিক।

ক্রিকেটের এই দুই মহারথীর পাশে রফিকের উইকেট সংখ্যা নগণ্য মনে হতে পারে। নেই তার টেস্টে এক ইনিংসে ১০ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড, নেই একক নৈপুণ্যে দলকে শত শত ম্যাচ জেতানোর গল্প। তবু, তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে এক অনন্য মহাতারকা ছিলেন। তাঁর হাত ধরেই দেশের ক্রিকেট প্রথমবার পেয়েছিল জয়, পেয়েছিল স্বপ্ন।

রফিকের অলরাউন্ড দক্ষতাই বিশ্বকাপের দরজা খুলেছিল বাংলাদেশের জন্য। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে তাঁর ব্যাটিং-বোলিংয়ের অলিখিত কাব্যেই বাংলাদেশ পেয়েছিল ক্রিকেট বিশ্বে পা রাখার চাবিকাঠি। সেদিন তিনি ওপেনিংয়ে নেমে রেখেছিলেন দারুণ অবদান। বল হাতেও রেখেছিলেন দাপট। নিয়েছিলেন ১৯টি উইকেট, যা ছিল টুর্নামেন্টে যৌথভাবে সর্বোচ্চ। 
 
সেই ম্যাচ থেকে শুরু হয় রফিকের রূপকথার যাত্রা। দীর্ঘ সময় ধরে বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছেন তিনি নিরলসভাবে। টেস্ট হোক বা ওয়ানডে, প্রতিটি ফরম্যাটেই রেখে গেছেন নিজের স্বাক্ষর। বল হাতে ছিলেন ভয়ংকর, ব্যাট হাতে ছিলেন ছোট ছোট ঝড় তোলা এক যুদ্ধজয়ী আগ্রাসী ব্যাটার।

রফিকের প্রকৃত পরিচয় ছিল বাঁহাতি স্পিনার হিসেবে। বিশ্বের বড় বড় ব্যাটারদের তিনি ফেলতেন ঘোর বিপাকে। এক সময় বাংলাদেশ দলে তিনিই ছিলেন একমাত্র নির্ভরযোগ্য অলরাউন্ডার। টেস্ট ও ওয়ানডেতে ১০০টিরও বেশি উইকেট নিয়েছেন, আর ব্যাট হাতে করেছেন এক হাজারের বেশি রান।

তবে দুর্ভাগ্য ছিল বাংলাদেশের অধিকাংশ টেস্টই সে সময় ইনিংস ব্যবধানে হারে, ফলে প্রতিপক্ষের দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ের সুযোগ খুব কম পেয়েছিলেন। এ কারণেই তার উইকেট সংখ্যা তুলনামূলক কম। এমনকি নিজের সেরা বোলিং পারফরম্যান্সেও দলকে জেতাতে পারেননি, কারণ দলের ব্যাটিং থাকত না যথাযথ স্থিতিশীলতায়।

তবু, ব্যাটিংয়ে তাঁর ছোট ছোট ইনিংসগুলো আজও স্মৃতিতে অমলিন। বাংলাদেশের ইনিংসে যখন ওঠা-পড়ার মিছিল চলে, গ্যালারির নজর থাকত রফিকের দিকে! তিনি কখন নামবেন, কেমন রং তোলবেন। পাহাড়সম সংগ্রহ না করলেও, সেসব ইনিংস তখনকার বাংলাদেশের জন্য ছিল অনেক বড় পাওয়া।

যদিও সাধারণত লোয়ার অর্ডারে ব্যাট করতেন, দলের প্রয়োজনে একাধিকবার ওপেনিংয়ে নেমেছেন। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফির ফাইনালে ওপেন করে ২৬ রান করেছিলেন। দ্বিতীয় উইকেটে ৫০ রানের দারুণ এক জুটিও গড়েছিলেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত ফাইনালে এই জুটিই জয়ের ভিত্তি গড়ে দিয়েছিল। বোলিংয়েও নিয়েছিলেন তিন উইকেট। 

১৯৯৮ সালের বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে জয়ে কেনিয়ার বিপক্ষে ওপেনিং করেন ৭৭ রান ও বোলিংয়ে ৩ উইকেট শিকার করেন। উদ্বোধনী জুটিতে আতহার আলী খানের সঙ্গে ১৩৭ রানের অবিস্মরণীয় এক জুটিও গড়ে তোলেন।

২০০৪ সালে ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে রফিক করেন ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। অবাক করার মতো বিষয় হল, সেদিন রফিক ব্যাট করতে নেমেছিলেন ৯ নম্বরে। অথচ সেই ম্যাচেই তিনি খেলেন ১১১ রানের এক অনবদ্য ইনিংস, যেখানে ছিল ১১টি চারের সাথে ৩টি ছক্কার ঝলক। রফিক যখন ব্যাট করতে নামেন, তখন বাংলাদেশ ছিল বেশ চাপের মুখে। তবে ধীরে ধীরে দায়িত্বশীল ব্যাটিংয়ে ইনিংসকে টেনে তোলেন তিনি। নবম উইকেটে তাপস বৈশ্যের (৯ রান) সঙ্গে গড়েন ৩৩ রানের কার্যকর জুটি। এরপর দশম উইকেটে তারেক আজিজকে (৬ রান) সঙ্গে নিয়ে যোগ করেন আরও ৪৬ রান। দুই জুটি, যা বাংলাদেশের সংগ্রহ ৪০০ ছাড়াতে সাহায্য করে। একজন স্পিনার হিসেবে যা ছিল এক দুর্লভ কীর্তি।

২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের পাশাপাশি প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়েও ব্যাটে-বলে ছিলেন রফিক উজ্জ্বল। ওয়ানডে সিরিজ জয়ের নির্ধারণী ম্যাচেও ব্যাটে-বলে রেখেছেছিলেন দারুণ অবদান। সেদিন ওপেনিংয়ে নেমে করেছিলেন বাজিমাত। ১৯৯ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে ৬৬ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন, যেখানে ছিল ৭ চার ও ৪ ছক্কা। দ্বিতীয় উইকেটে আফতাব আহমেদের সঙ্গে ১৫০ রানের স্মরণীয় জুটি গড়ে দলকে সিরিজ জেতান। একই ম্যাচে বল হাতে নিয়েছিলেন ২ উইকেট। তিনি হন সিরিজের সেরা খেলোয়াড়।

১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ের পর প্রধানমন্ত্রী তাঁকে গাড়ি বা বাড়ি চাইতে বললেও, রফিকের একটাই অনুরোধ ছিল। নিজের জন্মস্থান বুড়িগঙ্গার কাছে বাবু বাজারে একটি ব্রিজ নির্মাণ করা, যাতে মানুষের যাতায়াত সহজ হয়।

নিজের প্রাপ্ত জমি দান করেন বস্তির শিশুদের জন্য স্কুল গড়ে তোলার কাজে। গাড়ি বিক্রি করে পাওয়া টাকাও স্কুলের ভবন নির্মাণে ব্যবহার করেন। নিজের জীবনযাত্রার উন্নতির বদলে তিনি ভাবতেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের শিক্ষাকে এগিয়ে নিতে।

২০০৭ সালের ক্যারিবীয় বিশ্বকাপে রফিক ছিলেন দুর্দান্ত ফর্মে। ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়ে বল হাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তবে সেটিই হয় তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপ।

তারপর ভারতের বিপক্ষে ঘরের মাঠে, এবং দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ খেলেই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান। সেই সিরিজের শেষ টেস্টে প্রোটিয়া ব্যাটার রবিন পিটারসেনকে সাজঘরে ফেরিয়ে বাংলাদেশের প্রথম বোলার হিসেবে টেস্টে ১০০ উইকেটের মাইলফলক স্পর্শ করেন। রফিকের সেরা টেস্ট বোলিং ফিগারও ছিল প্রোটিয়াদের বিপক্ষে। ২০০৩ সালে ঢাকা টেস্টে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে ৭৭ রানে ৬ উইকেট নিয়েছিলেন বাংলাদেশের এই স্পিন জাদুকর। 

তখন চাপ ও পরিস্থিতির কারণে তাঁকে অবসরে যেতে হয়েছিল। খেলতে চেয়েছিলেন আরও, কিন্তু নির্বাচকদের দৃষ্টিভঙ্গি ও বয়স নীতির কারণে সুযোগ পাননি। বিদায়ের পর ভারতের ‘বিদ্রোহী’ টি-টোয়েন্টি লিগ আইসিএলে অংশ নেওয়ায় ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞাও পান, যদিও এক বছরের মধ্যেই তা তুলে নেয়া হয়।

২০২৩ বিপিএলে রংপুর রাইডার্সের কোচিং প্যানেলে ছিলেন বাংলাদেশের সাবেক স্পিন তারকা মোহাম্মদ রফিক। সেই দলে খেলতে এসে পাকিস্তানি অলরাউন্ডার শোয়েব মালিক প্রস্তুতির অংশ হিসেবে নেটে রফিকের মুখোমুখি হন। বাঁহাতি স্পিনারদের মোকাবেলায় কৌশল রপ্ত করতে রফিকের কাছ থেকেই পরামর্শ ও অনুশীলন নেন তিনি। নেট অনুশীলন শেষে রফিকের ফিটনেস ও বোলিং দক্ষতার প্রশংসা করে সেবার মালিক বলেছিলেন, “এখনো তিনি নেটে যেভাবে বল করেন, এমনকি যেভাবে ফুটবল খেলেন, তাতে বোঝা যায়। তিনি এখনও দারুণ ফিট!”

বয়স অর্ধশতক পেরিয়েও মাস্টার্স ক্রিকেট, কর্পোরেট ক্রিকেট ও প্রীতি ম্যাচে এখনও ব্যাট-প্যাড পরে নামেন রফিক। চার-ছক্কার ঝড় তুলতে পারেন আগের মতোই। 

তবু বিসিবির কোনো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় নেই তিনি, না স্পিন কোচ, না পরামর্শক। এই অবজ্ঞা শুধু একজন ক্রিকেটার নয়, বাংলাদেশের ক্রিকেট কাঠামোর প্রতি একটি নেতিবাচক সংকেত।

বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই হারানো নায়কের অবদান আজও বিস্মৃত। সময় এসেছে তাকে সম্মান জানিয়ে তাঁর অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর।
 

Details Bottom