সব প্রথমের নায়ক: হাবিবুল বাশার সুমনের অধিনায়কত্বের জাদুকরী অধ্যায়
৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল
প্রকাশ: 2 ঘন্টা আগেআপডেট: 20 সেকেন্ড আগে
সব প্রথমের নায়ক: হাবিবুল বাশার সুমনের অধিনায়কত্বের জাদুকরী অধ্যায়
সব প্রথমের নায়ক: হাবিবুল বাশার সুমনের অধিনায়কত্বের জাদুকরী অধ্যায়
বাংলাদেশ ক্রিকেট ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে, যাদের অবদান সংখ্যার ঝলক নয়, বরং সময়োপযোগী সাহসী সিদ্ধান্ত আর পথপ্রদর্শক ভূমিকায় বিবেচিত হয়। হাবিবুল বাশার সুমন সেই তালিকার একদম উপরের দিকে থাকা এক নাম। তার ব্যাটে ছিল নিরব ধারাবাহিকতা, আর নেতৃত্বে ছিল সাহস, স্থিরতা ও এক নতুন দিনের স্বপ্ন দেখানোর ক্ষমতা।
বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পেল ২০০০ সালে, কিন্তু তা অর্জনের পরও দলের পারফরম্যান্স ছিল শোচনীয়। একের পর এক পরাজয়ে আত্মবিশ্বাস ছিল তলানিতে। তখন হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্বে বদলে যেতে শুরু করে দৃশ্যপট।
এই ভাঙাচোরা দলকে গুছিয়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য ও প্রতিযোগিতামূলক দলে রূপান্তর করেছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন।
একে একে আসে দেশের প্রথম টেস্ট জয়, প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়, ওয়ানডেতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের বিরুদ্ধে জয়, এমনকি বিশ্বকাপে ঐতিহাসিক সাফল্য।
বাশারের নেতৃত্বে সাহসী বাংলাদেশ
হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্বে বাংলাদেশ দল যেন আত্মবিশ্বাসের নতুন সংজ্ঞা পেয়েছিল। ২০০৫ সালে ঘরের মাঠে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে পাওয়া প্রথম টেস্ট জয় ছিল তার অধিনায়কত্বের এক অনন্য অর্জন। সেই ম্যাচেই স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র প্রথম ইনিংসে কোনো উইকেট না পেলেও, বাশার তার ওপর আস্থা রেখেছিলেন। দ্বিতীয় ইনিংসে এনামুল হক ৬ উইকেট নিয়ে জয় এনে দেন দলকে।
এই সিরিজেই বাংলাদেশ পায় প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়। এরপর আসে প্রথম ওয়ানডে সিরিজ জয়ও, প্রতিপক্ষ একই জিম্বাবুয়ে। এরপর যে জয়ের ধারা গড়াতে শুরু করে, তা বাংলাদেশের ক্রিকেটের ইতিহাসের সবচেয়ে উজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা ছিল।
ইতিহাস গড়া ২০০৫ ও ২০০৭; অস্ট্রেলিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে জয়
২০০৫ সালে কার্ডিফে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে চমকে দেয় পুরো বিশ্ব। মোহাম্মদ আশরাফুলের দুর্দান্ত সেঞ্চুরি আর দলীয় বোলিং পারফরম্যান্সে পাওয়া এই জয় বাশারের অধিনায়কত্বের এক স্মরণীয় মুহূর্ত।
২০০৭ সালের বিশ্বকাপে বাংলাদেশের পারফরম্যান্স ছিল আরেক মাইলফলক। প্রস্তুতি ম্যাচে নিউজিল্যান্ডকে হারানোর পর মূলপর্বে ভারতের বিপক্ষে ঐতিহাসিক জয়, আর দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দলকে হারিয়ে সুপার এইটে উত্তরণ; সবকিছুতেই সামনে ছিলেন বাশার।
ব্যাটে ধারাবাহিকতা, ‘মি. ফিফটি’র খেতাব
হাবিবুল বাশার কখনোই একজন আগ্রাসী ব্যাটার ছিলেন না, কিন্তু ধারাবাহিকতার দিক থেকে ছিলেন নির্ভরতার প্রতীক। টেস্ট ক্যারিয়ারে ৫০ ম্যাচে ৩০.৮৭ গড়ে তার রান সংখ্যা ৩০২৬। যা ছিল বাংলাদেশের হয়ে প্রথম ব্যাটার হিসেবে টেস্টে ৩০০০ রান ছোঁয়ার কৃতিত্ব।
যেখানে রয়েছে ৩টি শতক আর চোখ ধাঁধানো ২৪টি অর্ধশতক। তাই তাকে ক্রিকেটভক্তরা ‘Mr. Fifty’ বলতেই বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। ওয়ানডেতে তার ব্যাটে আসে ১৪টি হাফ-সেঞ্চুরি, যদিও তিন অঙ্কের ঘরে পা রাখা হয়নি কখনো।
উত্তরসূরিদের গড়ার কারিগর
মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিক; যাদের কাঁধে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ বিশ্বমঞ্চে দাপট দেখিয়েছে, তাদের আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয়েছিল হাবিবুল বাশারের অধিনায়কত্বে। তারা অনেকেই স্বীকার করেছেন, দলের মধ্যে একতা, সহনশীলতা আর সাহসী নেতৃত্বের যে ভিত্তি বাশার তৈরি করেছিলেন, সেটাই পরবর্তীতে দলকে বড় কিছু করার জন্য তৈরি করেছিল।
শাহরিয়ার নাফীস একবার গণমাধ্যমে মন্তব্য করেছিলেন, “মাশরাফীর অধিনায়কত্বের অন্যতম গুণ ছিল, তিনি সবাইকে আগলে রাখতে পারতেন। এটা আমরা প্রথমে বাশার ভাইয়ের মধ্যেই দেখেছিলাম।”
নেতৃত্ব হারানো ও বিসিবির ‘চুপিচুপি’ সিদ্ধান্ত
২০০৭ বিশ্বকাপে ভালো নেতৃত্ব দিলেও, ব্যাট হাতে ফর্মে ছিলেন না বাশার। এরপর ঘরের মাঠে ভারতের বিপক্ষে সিরিজে ব্যাটে রান না থাকায়, একরকম ‘বাধ্য হয়ে’ নির্বাচকরা তার জায়গায় অধিনায়ক করেন মোহাম্মদ আশরাফুলকে এবং সহ-অধিনায়ক মাশরাফিকে।
বাশারের সামনে সেখানেই মাঠ থেকে বিদায়ের সুবর্ণ সুযোগ ছিল, কিন্তু তিনি নিজেই তা নেননি। এরপর তাকে আর জাতীয় দলে দেখা যায়নি।
আইসিএলে যোগ দিয়ে নিষিদ্ধ জীবন
জাতীয় দলে ফেরার দরজা বন্ধ দেখে তিনি যোগ দেন ভারতের বিপ্লবী ক্রিকেট লিগ ICL (Indian Cricket League)-এ। সেখানে ছিলেন আরও অনেক বাংলাদেশি তারকা শাহরিয়ার নাফীস, আফতাব আহমেদ, অলক কাপালি প্রমুখ।
এটি ছিল বিসিসিআই-বিরোধী একটি টুর্নামেন্ট, ফলে অংশগ্রহণকারী সবাই পায় দীর্ঘমেয়াদি নিষেধাজ্ঞা। বাশারকে দেওয়া হয় ১০ বছরের নিষেধাজ্ঞা।
তবে বছর না ঘুরতেই এই নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেওয়া হয়। বাশার ফিরে আসেন ঘরোয়া ক্রিকেটে, কিন্তু জাতীয় দলে জায়গা ফিরে পাননি আর কখনো।
নির্বাচক প্যানেলে থেকেও সাফল্য ম্লান
খেলোয়াড়ি জীবনের পর বাশার আসেন বাংলাদেশ জাতীয় দলের নির্বাচক প্যানেলে। সেখানে তার ভূমিকা ছিল অনেকটা পার্শ্বচরিত্রের, যা ছিল মতামত দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। সিদ্ধান্ত নিতেন প্রধান নির্বাচক ও বিসিবির নীতিনির্ধারকেরা।
এই কারণে তিনি কতটা সফল বা ব্যর্থ ছিলেন, তা নির্দিষ্টভাবে বলা কঠিন। তবে নির্বাচক প্যানেলের কিছু ভুল সিদ্ধান্ত, সিরিজে খারাপ পারফরম্যান্স, দলে ভারসাম্যের অভাব। সবকিছুর দায় একা না হলেও, একটি অংশ তাকেও নিতে হয়।
নায়কের বিদায়, ইতিহাসের পাতায় চিরস্থায়ী
হাবিবুল বাশার হয়তো ক্রিকেট বিশ্বে ওয়ানডে বা টেস্ট র্যাঙ্কিংয়ের এক নম্বর ব্যাটার ছিলেন না, বা অধিনায়ক হিসেবে ট্রফির ঝুড়ি ভরাননি। কিন্তু তিনি ছিলেন সেই ব্যক্তি, যার নেতৃত্বে বাংলাদেশ পেয়েছিল প্রথম টেস্ট এবং ওয়ানডে সিরিজ বিজয়ের স্বাদ, পেয়েছিল আত্মবিশ্বাসের বীজ।
আজকের বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার, আজকের সাহসী বাংলাদেশ দলের পেছনে যিনি প্রথম ভিত্তি গড়েছিলেন; তিনি ছিলেন হাবিবুল বাশার সুমন।
নিয়তির খেলায় তার ক্যারিয়ার থেমে গেলেও, তার অবদান ইতিহাসে লেখা থাকবে সোনালি হরফে। হয়তো ক্রিকেট মাঠে আর ফিরবেন না, কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেটের সব প্রথম সাফল্যের ক্যানভাসে থাকবে তারই ছবি। নির্ভীক, নিঃশব্দ, কিন্তু পথপ্রদর্শক এক নায়ক।