নির্বাচকের দায়িত্বে নব্বই দশকের পেস তারকা শান্ত
৯৭ প্রতিবেদক: মোহাম্মদ আফজল
প্রকাশ: 3 ঘন্টা আগেআপডেট: 7 মিনিট আগে
নির্বাচকের দায়িত্বে নব্বই দশকের পেস তারকা শান্ত
নির্বাচকের দায়িত্বে নব্বই দশকের পেস তারকা শান্ত
বাংলাদেশ ক্রিকেটের নব্বই দশকের যে ক’জন প্রতিভাবান ক্রিকেটার আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম নাম হাসিবুল হোসেন শান্ত। জাতীয় দলে তাঁর উত্থান যেমন আকস্মিক ছিল না, তেমনি তাঁর ভূমিকা ছিল নিঃশব্দ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফি জয়ে যার অবদান স্মরণীয়, সেই শান্ত এবার যুক্ত হয়েছেন জাতীয় দলের নির্বাচক প্যানেলে। দীর্ঘদিন বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নির্বাচকের দায়িত্ব পালনের পর এবার বড় মঞ্চে তাঁর প্রত্যাবর্তন।
মাত্র ১৭ বছর বয়সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় শান্তর, ১৯৯৫ সালে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচ দিয়ে শুরু হয় এই গতি তারকার পথচলা। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সবচেয়ে গতিসম্পন্ন বোলার হিসেবে তখনই আলোচনায় চলে আসেন তিনি। মাঠে তাঁর গতি ও আক্রমণাত্মক মনোভাব ছিল দলের পেস আক্রমণের মূল ভিত্তি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের ইতিহাসে ১৯৯৭ সালের ১৩ এপ্রিল ছিল এক বিশেষ দিন। মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে প্রতিপক্ষ কেনিয়া, শর্ত ছিল– জয় পেলে বাংলাদেশ পাবে বিশ্বকাপে খেলার টিকিট। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে স্টিভ টিকলোর ১৪৭ রানের ওপর ভর করে কেনিয়া করে ২৪১ রান। এরপর বৃষ্টির কারণে বাংলাদেশের লক্ষ্য দাঁড়ায় ২৫ ওভারে ১৬৬ রান। রফিক, নান্নু, আমিনুল ও আকরামদের ব্যাটে লক্ষ্য যখন নাগালের মধ্যে, তখন শেষ বলে দরকার ছিল এক রান। ক্রিজে ছিলেন হাসিবুল হোসেন শান্ত ও খালেদ মাসুদ পাইলট। শান্ত স্ট্রাইকে। মূলত বোলার হলেও, শান্ত সেদিন ব্যাট হাতে এক রান নিয়ে নিশ্চিত করেন বাংলাদেশের জয়। কুয়ালালামপুরের সেই এক রান শুধু ম্যাচ জয়ের নয়, বরং ছিল এক দেশের ক্রিকেট ইতিহাস বদলে দেওয়ার মুহূর্ত। মাঠে দৌড়ে আসা সেই দৃশ্য আজও অনেকের স্মৃতিতে অমলিন।
৯৭-এর সেই দৌড় শুধু এক জয় নয়, ছিল অনুপ্রেরণার শুরু। সেই মুহূর্ত নিয়ে বাংলাদেশ দলের সবচেয়ে সফল পেসার ও সাবেক অধিনায়ক মাশরাফি বিন মুর্তজা একবার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছিলেন,“৯৭ সালের শান্ত ভাই আর পাইলট ভাইয়ের দৌড়ের পর আমার মতো অনেকেই আজ দৌড়ায়……”
১৯৯৯ সালের বিশ্বকাপে স্কটল্যান্ডের বিপক্ষে জয় ছিল বাংলাদেশের প্রথম বিশ্বকাপ জয়। সেই ম্যাচে বল হাতে দুটি উইকেট তুলে নিয়েছিলেন শান্ত। বাংলাদেশের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শান্তর কীর্তিও কম নয়। ১৯৯৭-৯৮ মৌসুমে দেশের প্রথম শ্রেণির এক ম্যাচে ১৪৩ রানে ৬ উইকেট নেন তিনি, যা ছিল সে সময়কার সেরা বোলিং ফিগার। এর পাশাপাশি, বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচে তিনিও রেখেছেন ইতিহাসগড়া ভূমিকা—কারণ সেই ম্যাচে প্রথম বলটি করেছিলেন তিনিই।
শান্তর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে পাঁচটি টেস্ট ম্যাচে নিয়েছেন ৬ উইকেট এবং ৩২টি ওয়ানডেতে পেয়েছেন ২৯ উইকেট। তবে এই ক্যারিয়ার দীর্ঘ হয়নি। দেশের ক্রিকেটে নতুন গতি তারকা হিসেবে মাশরাফি বিন মর্তুজার আবির্ভাবের পর জাতীয় দলে নিজের জায়গা ধরে রাখা সম্ভব হয়নি শান্তর পক্ষে। মাশরাফির গতি ও ধার ছিল সময়ের দাবি, ফলে ২০০৪ সালে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান দেশের একসময়ের সবচেয়ে দ্রুতগতির এই পেসার।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় বললেও ঘরোয়া ক্রিকেটে তিনি ছিলেন আরও কয়েক বছর। ২০০৭ সালে চূড়ান্ত বিদায়ের আগ পর্যন্ত ঘরোয়া ক্রিকেটে নিয়মিত খেলেছেন। ২০০৫-০৬ মৌসুমে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নিজের বিভাগ সিলেটের হয়ে নয় ম্যাচে নেন ৫৭টি উইকেট। ওই মৌসুমে সাতবার ইনিংসে পাঁচ বা তার বেশি উইকেট এবং দুবার ম্যাচে ১০ উইকেট নেওয়ার কৃতিত্ব ছিল তাঁর ঝুলিতে। তবে ইনজুরি এবং ওভারস্টেপিংয়ের কারণে শেষমেশ বিদায় নিতে হয় সবধরনের ক্রিকেট থেকে।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ৫২ ম্যাচে ১৬৮ উইকেট এবং লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ৮৫ ম্যাচে ১০৯ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড রয়েছে শান্তর।
দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটের মঞ্চ ছেড়ে দেওয়ার পর দীর্ঘদিন ধরে বিসিবির বয়সভিত্তিক দলের নির্বাচক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।
জাতীয় দলের সাবেক নির্বাচক হান্নান সরকার, যিনি একসময় বয়সভিত্তিক ক্রিকেটেও নির্বাচকের দায়িত্বে ছিলেন, সেখানে দীর্ঘদিন তাঁর সঙ্গে কাজ করেছেন হাসিবুল হোসেন শান্ত। বছরের শুরুতে হান্নান কোচিংয়ে মনোযোগ দিতে জাতীয় দলের নির্বাচক প্যানেল থেকে সরে দাঁড়ান এবং আবাহনীর কোচ হিসেবে দলকে এনে দেন শিরোপা। তাঁর জায়গায় এবার জাতীয় দলের নির্বাচক প্যানেলে যুক্ত হয়েছেন শান্ত, যিনি বয়সভিত্তিক পর্যায়ে কাজের ধারাবাহিকতায় উঠে এসেছেন মূল দলে।
এছাড়াও বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগে (বিপিএল) একবার সিলেট সিক্সার্সের ম্যানেজারের দায়িত্বও পালন করেছেন শান্ত।
নব্বই দশকের যাঁরা বাংলাদেশের ক্রিকেটে আলো ছড়িয়েছেন—আকরাম খান, আমিনুল ইসলাম বুলবুল, মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, মেহরাব হোসেন অপি, শাহরিয়ার হোসেন বিদ্যুৎ ও আল শাহরিয়ার রোকনদের মতো নামের পাশে হাসিবুল হোসেন শান্তর নামটিও উচ্চারিত হয় সমান গুরুত্বে।
শুধু বল হাতে নয়, প্রয়োজনের মুহূর্তে ব্যাট হাতেও দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে নিজের ছাপ রেখে যাওয়া এই পেসার এখন জাতীয় দলের ক্রিকেটীয় ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্বে। সময়ের আবর্তে খেলোয়াড় থেকে নির্বাচক হয়ে ওঠার এই যাত্রা শান্তর জন্য যেমন পরিণতির আরেক নাম, তেমনি দেশের ক্রিকেটের জন্যও এটি হতে পারে এক নতুন সম্ভাবনার সূচনা।